Saturday 22 June 2019

*মুহাম্মদ মুরসি : একজন মহানায়কের জীবনের খতিয়ান*

*মুহাম্মদ মুরসি : একজন মহানায়কের জীবনের খতিয়ান*

*ইফতেখার, জামিল*

মুহাম্মদ মুরসি। মিশর ও আরবের জনগণ মাঠে-ময়দানে যাঁর নামে বারবার শ্লোগান দিয়েছেন। রাজনীতি ও ইতিহাসের পাতা থেকে যাঁর নাম কখনো মুছে ফেলা যাবে না। যিনি রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে রাষ্ট্রপতি ভবন থেকে কারাগারে গিয়েছেন। একাকী সেলে বন্দী ছিলেন দীর্ঘদিন। এবং গতকাল প্রতারক বিচারকদের সামনে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন। মিশরের প্রথম গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি থেকে আধুনিক মিশর ও মধ্যপ্রাচ্যের প্রথম জননেতা হিসেবে কারাগারেই ইন্তেকাল করলেন।

*প্রাথমিক, জীবন*

মুহাম্মদ মুরসি ইসা আইয়াত ১৯৫১ খ্রিষ্টাব্দের আগস্ট মাসে উত্তর মিশরের শারকিয়া জেলার আদওয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। গ্রামে থাকতেই হিফজ শেষ করেন এবং সেখানেই প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা গ্রহণ করেন। উচ্চশিক্ষার জন্য মিশরের রাজধানী কায়রোতে আসেন এবং কায়রো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৭৫ সালে প্রকৌশল বিষয়ে স্নাতক ও ১৯৭৮ সালে একই বিষয়ে সম্মান ডিগ্রি লাভ করেন। এ বছরই তিনি উচ্চ শিক্ষার্থে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যান। ১৯৮২ সালে ইউনিভার্সিটি অফ সাউথ ক্যালিফোর্নিয়াতে মুহাম্মাদ মুরসির প্রকৌশল বিষয়ে গবেষণা শেষ হয় এবং তিনি ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেন।

*কর্মজীবন*

স্নাতক শেষ করে তিনি কায়রো বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৭৫-৭৬ সালে মিশর সেনাবাহিনীতে সেবা দান করেন। ১৯৮২ সালে ক্যালিফোর্নিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটি, নর্থরিজে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন এবং ১৯৮৫ সালে শারকিয়া প্রদেশের যাকাযিক বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেয়ার উদ্দেশ্যে ক্যালিফোর্নিয়ার অধ্যাপনার চাকরি ছেড়ে মিশরে চলে আসেন। এই বিশ্ববিদ্যালয়েই তিনি ২০১০ পর্যন্ত অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়া লিবিয়ান ফাতেহ বিশ্ববিদ্যালয়েও তিনি অধ্যাপক হিসেবে কাজ করেছেন।

*আদর্শিক ও রাজনৈতিক, জীবন*

ছাত্রজীবন থেকেই মুহাম্মদ মুরসি ইসলামি ধারা গ্রহণ করেন। ১৯৭৭ সালে ইখওয়ানুল মুসলিমিনে যোগ দেন। শুরু থেকেই মুহাম্মদ মুরসি ইখওয়ানের সাংগঠনিক কাঠামোর সাথে জড়িত ছিলেন। ১৯৯২ সালে ইখওয়ান রাজনৈতিক শাখা গঠন করলে শুরু থেকেই এর সদস্য হিসেবে কাজ করেছেন এবং পরবর্তী সময়ে সর্বোচ্চ কমিটির সদস্য হিসেবে নিযুক্ত হয়েছেন। এর পাশাপাশি মুহাম্মদ মুরসি সবসময় সামাজিক ও সেবামূলক কাজে জড়িত ছিলেন। ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার বিরুদ্ধে সবসময় সোচ্চার ছিলেন।

২০০০ সালে মুহাম্মাদ মুরসি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। সাংগঠনিকভাবে তিনি ইখওয়ানুল মুসলিমিনের সদস্য হলেও, নির্বাচনে তাঁকে ইখওয়ানের অন্যান্য নেতাদের মতো আইনত স্বতন্ত্রভাবে লড়তে হয়, কারণ হোসনি মুবারাকের শাসনামলে মুসলিম ইখওয়ান মিশরের প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে নিষিদ্ধ ছিল। সংসদীয় মেয়াদে তিনি তাঁর ধারার নেতা হিসেবে দায়িত্তপ্রাপ্ত হন এবং সংসদে ভুমিকার জন্য বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ সাংসদ হিসেবে নির্বাচিত হন। বেশ কয়েকবার গ্রেপ্তার হন। এর মধ্যে ২০০৬ সালে বিচারক নিয়োগে অনিয়মের প্রতিবাদে ডাকা বিক্ষোভ থেকে তাঁকে আটক করা হয় এবং প্রায় সাত মাসের মতো তিনি বন্দী ছিলেন।

*আরব, বসন্ত*

২০১১ সালের ২8 জানুয়ারি অপর ২৪ ইখওয়ান-নেতার সাথে মুরসিও গ্রেপ্তার হন। দুই দিন পর তিনি কায়রোয় জেল থেকে পালিয়ে যান। দুর্গম ওদিউন নাতরুন কারাগার থেকে পলায়নের ঘটনা ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয়। মিশরের তৎকালীন বিশৃঙ্খল পরিস্থিতিতে কারাপ্রহরীরা পলায়ন করলে স্থানীয় জনতা তাঁদেরকে মুক্ত করেন। সিসি ক্ষমতা দখলের পর মুরসিকে এই ঘটনায় মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়।

*মিশরের,রাষ্ট্রপতি,নির্বাচন ২০১২*

মূলত দলীয় উপনেতা ও রাজনৈতিক প্রধান খাইরাত এল-শাতেরই ছিলেন মুসলিম ব্রাদারহুডের মূল রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থী। কিন্তু একটি আদালত প্রচারণা শুরুর আগে শাতের-সহ একাধিক প্রার্থীকে নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করলে ইখওয়ানের রাজনৈতিক শাখা-পক্ষ থেকে প্রার্থী হিসেবে মুহাম্মাদ মুরসির নাম উঠে আসে, যিনি মূলত সংগঠনটির দ্বিতীয় মনোনয়ন ছিলেন। পরে ইখওয়ানের রাজনৈতিক শাখা ফ্রিডম অ্যান্ড জাস্টিজ পার্টি মুরসিকে তাদের প্রার্থী হিসেবে চূড়ান্ত করে।

ইখওয়ানের এক দলত্যাগী জনপ্রিয় নেতার অংশগ্রহণ সত্ত্বেও মুহাম্মাদ মুরসি ২৩ মে, ২০১২-এর নির্বাচনে ২৫.৫ শতাংশ ভোট পান, যা ছিল সর্বোচ্চ। প্রথম পর্বের পর মুহাম্মাদ মুরসি এবং আহমেদ শফিক দ্বিতীয় পর্বের চূড়ান্ত ভোটাভুটির জন্য মনোনীত হন। দ্বিতীয় পর্বের নির্বাচনের আগে মুহাম্মাদ মুরসি মিশরের সর্বস্তরের মানুষের প্রতি আহমেদ শফিকের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ার আহ্বান জানান।

মুরসির রাজনৈতিক দল আহমেদ শফিককে, যিনি সাবেক বিমান বাহিনী প্রধান এবং হোসনি মুবারাকের অধীনের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন, ক্ষমতাচ্যুত মুবারাকের রক্ষাকর্তা হিসেবে আখ্যায়িত করে প্রচার করে এবং বলে শফিক নির্বাচিত হলে মিশরের ক্ষমতাচ্যুত স্বৈরশাসন নতুন জীবন পাবে। ২৪ জুন ২০১২ তারিখে মুরসিকে দ্বিতীয় পর্বের নির্বাচনে জয়ী, অর্থাৎ রাষ্ট্রপতি হিসেবে নির্বাচিত ঘোষণা করা হয়। এর পরপরই মুরসি ইখওয়ান ও ফ্রিডম অ্যান্ড জাস্টিস পার্টি থেকে আনুষ্ঠানিক অব্যাহতি গ্রহণ করেন।

*প্রতিবিপ্লব*

এক বছর যেতে না যেতেই মুরসি সরকারের প্রতিরক্ষামন্ত্রী আবদুল ফাত্তাহ সিসি মুরসির বিরুদ্ধে অনাস্থা জানান এবং সাময়িকভাবে সংবিধান স্থগিত করা হয়। বিচারপতি আদলি মনসুর অন্তর্বর্তীকালীন প্রধান হিসেবে নিযুক্ত হন। জনবিক্ষোভের অজুহাতে সামরিক বাহিনী মুরসির সরকারকে বরখাস্ত করে।

মুরসিকে আটক করে অজানা স্থানে নিয়ে যাওয়া হয়। কয়েক মাস পর তাঁকে আদালতে হাজির করে বিভিন্ন ধরনের অভিযোগ করা হয়। যার মধ্যে কারাগার থেকে পলায়ন ও হামাসের সাথে গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগ অন্যতম। এ দুটো অভিযোগে তাঁকে ২০১৫ সালে যথাক্রমে ফাঁসি ও যাবজ্জীবন কারাদণ্ড প্রদান করা হয়।

*মৃত্যু*

গতকাল (১৭ জুন ২০১৯, সোমবার) তাঁকে আদালতের সামনে হাজির করা হয়। তিনি আদালতের কাছে বক্তব্য দানের অনুমতি চান। তিনি বলেন, ‘আমার কাছে গোপন কিছু তথ্য আছে, মিশরের নিরাপত্তার কথা ভেবে তা আমি প্রকাশ করছি না।’ বক্তব্য দানের মাঝপথে তাঁকে থামিয়ে দিয়ে বিরতিতে চলে যাওয়া হয়। বিরতির সময়েই তিনি জ্ঞান হারিয়ে ঢলে পড়েন। আসামী সেলে তিনি একাই ছিলেন। পাশের সেল থেকে চিৎকার চেচামেচি শুরু করা হয়। আধা ঘণ্টা পর উদ্ধার করে তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। এভাবেই একজন মহামানবের জীবনের সমাপ্তি ঘটে ।

No comments:

Post a Comment