Wednesday 29 April 2020

Nobel corona virus (COVID 19)

কোবিড-19
অর্গেনিজম (Organism) (জীব):-
  আমাদের এই মহিবিশ্বে বিভিন্ন ধরনের জীবিত বস্তু যাদের বৃদ্ধি এবং প্রজনন হয় তাদেরকে অর্গেনিজম বলে। এইগুলি প্রানী, উদ্ভিদ, ফাঙ্গাস (ছত্রাক) বা ব্যাক্টেরিয়া হতে পারে।অনেকে আবার ভাইরাসকে অর্গেনিজমের বাইরে রেখেছেন। তার কারন হলো ভাইরাস নিজে নিজে তার বৃদ্ধি, প্রজনন এবং মেটাবোলিজম করতে পারে না। মেটাবোলিজম মানে কোন‌ও অর্গেনিজমের দেহের অভ্যন্তরে সংঘটিত হ‌ওয়া বিভিন্ন ধরনের শরীরবৃত্তীয় কার্যকলাপ। বিজ্ঞানের যে শাখায় অর্গেনিজম নিয়ে আলোচনা হয় ইহাকে বায়োলজি বলে।

মাইক্রোঅর্গেনিজম(Microorganism)(অনুজীব):-
অর্গেনিজমগুলোর আকার ও আকৃতি বিভিন্ন ধরনের হতে পারে। প্রকান্ড গাছ বা তিমি মাছ থেকে খালি চোখে দেখতে না পারা ব্যাক্টেরিয়া গুলি হল বিভিন্ন ধরনের অর্গেনিজম। এই গুলির মধ্যে যেসকল অর্গেনিজম খালি চোখে দেখতে পারা যায় না ,তাদেরকে মাইক্রোঅর্গেনিজম বলা হয়। বিভিন্ন ধরনের ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস,ফাঙ্গাস ইত্যাদি হলো মাইক্রোঅর্গেনিজমের উদাহরন। এইগুলি দেখতে হলে বিভিন্ন ধরনের মাইক্রোস্কোপ ব্যবহার করা হয়।মাইক্রোঅর্গেনিজমের উপর প্রথম বিজ্ঞান ভিত্তিক গবেষনা শুরু হয় 1670 সনে বিজ্ঞানী লিউয়েনহুকের আবিষ্কৃত মাইক্রোস্কোপের মাধ্যমে। মাইক্রোঅর্গেনিজম নিয়ে আলোচনা করা বিজ্ঞানের শাখাকে মাইক্রোবায়োলজি বলে।

ব্যাক্টেরিয়া( Bacteria):-
বিভিন্ন ধরনের মাইক্রোঅর্গেনিজমের মধ্যে ব্যাক্টেরিয়া অন্যতম। আমাদের পৃথিবীতে প্রথম জীবন সৃষ্টি হয়েছিলো 4 বিলিয়ন বৎসর পূর্বে এই ব্যাক্টেরিয়ার মাধ্যমে যেগুলি ছিলো এককোষী।তারা প্রায় ৩ বিলিয়ন ছিলো তারা মাইক্রোঅর্গেনিজম হিসাবে। ব্যাক্টেরিয়ার শরীরের গঠন গোলক,সোজা বা পেছানো আকৃতি হিসাবে থাকে। প্রায় সব জায়গাতেই এদেরকে পাওয়া যায়। তাই বিশ্বে সবচেয়ে বেশী তাদের‌ই সংখ্যা। অনুমান করা যায় সংখ্যাটি 5×10³⁰ । ব্যাক্টেরিয়া গুলি সহজীবি অথবা পরজীবি হিসাবে বসবাস করে। শিম জাতীয় গাছে নাইট্রোজেন সরবরাহ করতে  শিকড়ে রাইজোবিয়াম, দুধকে দৈয়ে পরিনত লেক্টোবেসিলাস সহ অনেক উপকারী ব্যাকটেরিয়া আছে আবার কলেরা, যক্ষা ইত্যাদি সহ অনেক রোগের দ্বারা পৃথিবীতে অনেক লোক মারা যাওয়ার পিছনে এই ব্যাক্টেরিয়া দায়ী। ব্যাক্টেরিয়া নিয়ে আলোচনা করা বিজ্ঞানের শাখাকে ব্যাকটেরিয়োলজি বলে।

ভাইরাস ( virus) এর (আবিষ্কার):-
তখন পর্যন্ত সন্দেহ  করা হতো যে প্রতিটি রোগের কারন ব্যাক্টেরিয়া। 1882 সনে লুই পাস্তুর নামক বিজ্ঞানী লক্ষ্য করলেন যে জলাতঙ্ক রোগের জীবানু গুলি সাধারন মাইক্রোস্কোপ দ্বারা দেখা সম্ভব হচ্ছে না।ফরাসী বিঞ্জানী চার্লস চেম্ভারলিন 1884 সনে একটি ফিল্টার আবিষ্কার করলেন যার বর্তমান নাম চেম্ভারলিন ফিল্টার। এই ফিল্টারের ছিদ্রগুলা এতো ছোট যে বিভিন্ন রোগের ব্যাক্টেরিয়া গুলিকে অনায়াসে ফিল্টারে আটকানো সম্ভব।1876 সনে নেদারল্যান্ডস এর ওয়াগেনিনজেন এ থাকা  কৃষিবিভাগ লক্ষ্য  করেছিলো যে তামাক গাছের পাতায় স্থানীয় ভাষায় বান্ট, রাস্ট বা স্মাট নামক  রোগ দেখা দিয়েছে।1886 সনে এই রোগের উপর কাজ করা বিজ্ঞানী এডলফ মেয়র রোগটির নাম দেন টোবাকো মোজাইক ।1892 সনে রাশিয়ান বিজ্ঞানী দিমিত্রির ইভানভস্কি  এই চেম্ভারলিন ফিল্টার দ্বারা এই রোগের জীবানু কে ফিল্টার করার চেষ্টা করলেন।তিনি লক্ষ্য করলেন যে ফিল্টার দ্বারা ব্যাক্টেরিয়া গুলি আটকানোর পরেও তামাক গাছগুলো রোগগ্রস্ত ছিলো।তিনি বললেন যে হয়তো ব্যাক্টেরিয়া দ্বারা উৎপন্ন কোন বিষাক্ত পদার্থ দ্বারা গাছগুলি আক্রান্ত হচ্ছে যেগুলি ফিল্টারে আটকানো সম্ভব হচ্ছে না।1898 সনে নেদারল্যান্ডস এর বিজ্ঞানী  মার্টিনাস বেইজারনিক ফিল্টার দ্বারা কয়েকটা পরীক্ষা করে নিশ্চিত হলেন যে , ফিল্টার করা বস্তুতে কোন‌ও বিষাক্ত পদার্থ রয়েছে যা কোন‌ও কোষের মধ্যে বৃদ্ধি পায়।তিনি ইহার নাম দিলেন কন্টাজিয়াম ভিভাম ফ্লোইডাম অর্থাৎ দ্রবনীয় জীবিত জীবানু।পরে ইহা ভাইরাস নামে আখ্যায়িত হয়। পরবর্তীতে মার্কিন বিজ্ঞানী ডব্লিউ এম স্টেনলি  তামাক পাতায় রোগের কারন হিসাবে  দায়ী করা টোবাকো মোজাইক ভাইরাস ( TMV) কে পৃথক করতে সক্ষম হন। তার জন্য উনাকে 1946 সনে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়। বিজ্ঞানের যে বিভাগে ভাইরাস নিয়ে অধ্যায়ন করা হয় তার নাম ভাইরোলজি।

ভাইরাসের উৎপত্তি:-
জীবিত কোষ সৃষ্টির সময় থেকেই সম্ভবতঃ ভাইরাসের উৎপত্তি। ভাইরাসের উৎপত্তি কিভাবে হয়েছে তা স্পষ্ট নয়। কারন ভাইরাস ফসিল হয় না।ফসিল বা জীবাশ্ম মানে কোন‌ও প্রাচীন জীব মাটির নীচে চাপা পড়ে পাথরে পরিনত হ‌ওয়া বুঝায়। প্রধান তিনটি থিয়োরী ভাইরাসের উৎপত্তি সম্পর্কে সঠিক ভাবে বর্ননা করতে পারে নাই।

ভাইরাসের আকার আকৃতি:-
যাই হোক এখন পর্যন্ত বুঝা গেলো ভাইরাস হলো অতি ক্ষুদ্র এক বস্তু, যাহার আকার 10 ন্যানো মিটার থেকে 300 ন্যানো মিটার পর্যন্ত। উল্লেখ্য 1 ন্যানো মিটার হলো 1 মিটারের 100 কোটি ভাগের এক ভাগ। কিছু ভাইরাস অবশ্য আর‌ও কিছু বড় হতে পারে। সুতরাং ইলেক্ট্রন মাইক্রোস্কোপ ছাড়া এদের দেখা সম্ভব নয়। সকল সজীব বস্তুতে ভাইরাস পাওয়া যায়। প্রানী উদ্ভিদ ছাড়াও মাটি, বায়ু বা জলেও ভাইরাস থাকতে পারে।শুধু জীব ও জড় এর মধ্যে ভাইরাস থাকতে পারে এমন নয়, এই ভাইরাস ব্যাকটেরিয়ার মধ্যেও থাকে, যাহাকে ব্যাক্টেরিয়োফেজ বলা হয়। ভাইরাসের গঠন গোলক, রড, সর্পিল বাঁক পেছানো সহ বিভিন্ন আকৃতির আছে।

ভাইরাসের গঠন:-
একটি সম্পূর্ণ ভাইরাসকে ভিরিয়ন বলা হয়। ভাইরাসের দেহে কোন‌ও নিউক্লিয়াস ও সাইট্রোপ্লাজম নাই। তাদের দেহ প্রোটিন ও নিউক্লিক এসিড দিয়ে গঠিত। জিনেটিক মেটেরিয়াল বা জিনোম এর নিউক্লিক এসিডের মধ্যে ডিএন‌এ অথবা আর‌এন‌এ এর যেকোন একটি থাকে।ডিএন‌এ থাকা ভাইরাসকে ডি‌এন‌এ ভাইরাস এবং আর‌এন‌এ থাকা ভাইরাসকে আর‌এন‌এ ভাইরাস বলে। ভাইরাসের দেহের জিনোমের বাহিরের প্রোটিনের আবরনকে ক্যাপসিড বলে।কিছু ক্ষেত্রে বাহিরে লিপিড নামক জৈব অনুর আবরন‌ও থাকে।

ভাইরাসের জীবন চক্র:-
 স্বাভাবিক অবস্থায় ভাইরাসের বিশেষ কোন‌ও পরিবর্তন হয় না। ভাইরাস অন্য কোন‌ও জীবের কোষের সংস্পর্শে এসে তার বংশ বিস্তার করে। যে কোষের সংস্পর্শে এসে ভাইরাসের পরিবর্তন হয়, এই কোষকে হোস্ট সেল বলা হয়। ভাইরাসের যখন কোনে কোষে সংক্রমণ তখন সেই কোষটিকে অনেক নতুন ভাইরাস সৃষ্টি করতে বাধ্য করে।এই প্রক্রিয়াতে ডিএন‌এ বা আর‌এন‌এ সৃষ্টি, ভাইরাসের প্রোটিন সৃষ্টি এবং শেষে সব মিলিত হয়ে নতুন ভাইরাসের সৃষ্টি হয়।
এই প্রক্রিয়া ছয়টি পর্যায়ে সম্পন্ন হয়-
(a) এটাছমেন্ট:- ভাইরাস কোন‌ও কোষ এর সাথে আবদ্ধ হ‌ওয়াকে এটাছমেন্ট বলে। কোন কোষের সাথে এটাছমেন্ট করবে তার নির্ভর করে ভাইরাসের ক্ষমতার উপর। যেমন উদ্ভিদ ভাইরাস শুধুমাত্র উদ্ভিদ কোষের সাথে এটাছমেন্ট হয়, প্রানী কোষের সাথে পারে না।
(b) পেনিট্রেশন:-এটাছমেন্ট হ‌ওয়া কোষের মধ্যে গলিয়া বা এনডোকাইটোসিস প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ভাইরাসের  প্রবেশ করাকে পেনিট্রেশন বলে।
(c) আনকোটিং:- পেনিট্রেশন এর পরে ভাইরাসের কেপসিড এর আবরন ধ্বংস হ‌ওয়াকে আনকোটিং বলে।এই কাজ  ভাইরাসের বা হোস্ট সেল এর এনজাইম করে থাকে।
(d) রেপ্লিকেশন:- তার পরে প্রোটিন সংশ্লেষণ এর মাধ্যমে নতুন ভাইরাল প্রোটিন সংশ্লেষণ হয়। ইহার দ্বারা ডিএন‌এ এবং আর‌এনএ সৃষ্টি হয়।ইহাকে রেপ্লিকেশন বলে।
(e) এসেম্বলি:- নতুন ভাইরাল প্রোটিন ও নিউক্লিক এসিড মিলিত হয়ে অসংখ্য নতুন ভাইরাসের সৃষ্টি করে।
(f) রিলিজ:- হোস্ট সেলের মধ্যে উৎপন্ন হ‌ওয়া অসংখ্য ভাইরাস হোস্ট সেল বিদীর্ণ হয়ে লাইসিস প্রক্রিয়ার মধ্যমে বের হয়।ইহাকে রিলিজ বলে। অবশ্য কিছু ভাইরাস যেমন এইছ‌আইভি স্বাভাবিকভাবেই রিলিজ হয়।ইহাকে বাডিং বলে।

ভাইরাস এবং রোগ:-
প্রানী এবং উদ্ভিদের দেহে বিভিন্ন ধরনের রোগ সৃষ্টি হয় এই ভাইরাসের সংক্রমনের জন্য।ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত নির্দিষ্ট জীবকে ভেক্টর বলা হয়।এই ভেক্টরের মাধ্যমে ভাইরাস সৃষ্ট রোগ বিস্তার লাভ করে। বিভিন্ন ধরনের ভেক্টর হলো মানুষ, অন্যান্য প্রানী,রক্ত চোষা কীটপতঙ্গ ইত্যাদি।ভাইরাস সরাসরিভাবেও বিস্তার লাভ করে। যেমন স্পর্শ, বায়ু, খাদ্য, অসুরক্ষিত যৌন ক্রিয়াকলাপ ইত্যাদি।মানুষের দেহে বিভিন্ন ধরনের ভাইরাস জনিত রোগ হলো --
এইডস  - ইনফ্লুয়েঞ্জা  -নিউমোনিয়া -ব্রন্কাইটিস
-জলাতঙ্ক  -বসন্ত  -সার্স  -মার্স  -ইবোলা  -ফ্লো
-কোবিড-১৯     -হাম    -জন্ডিস  ইত্যাদি।

ভাইরাসের শ্রেনীবিভাগ:-
ভাইরাসগুলো কে তাদের আকার ,আকৃতি, নিউক্লিক এসিডের ধরন, রেপ্লিকেশন এর ধরন, হোস্ট অর্গেনিজম, সৃষ্টি করা রোগ ইত্যাদির উপর ভিত্তি করে তাদের শ্রেনীবিভাগ করা হয়।এই শ্রেনীবিভাগ গুলির মধ্যে বাল্টিমোর, হোমস, এল‌এইসটি(LHT), আকারের উপর ভিত্তি করা শ্রেনীবিভাগ সহ ইন্টারনেশনেল কমিটি অন টেক্সোনমি অফ ভাইরাসেস(ICTV)এর শ্রেনীবিভাগগুলি অন্যতম।

কোরোনা ভাইরাস (CoV):-
ভাইরাসের একটি বিশেষ দলের নাম হলো কোরোনা ভাইরাস। ভাইরাসগুলো দেখিতে রাজার মুকুট বা সূর্যের করোনা এর মতো। তাই এই ভাইরাসের নাম দেওয়া হয় ল্যাটিন শব্দ কোরোনা থেকে যেটি মূলতঃ গ্রীক শব্দ  থেকে নেওয়া হয়েছে যার অর্থ  মুকুট ।

কোরোনা ভাইরাসের আবিস্কার:-
কোরোনা ভাইরাস আবিষ্কার হয় ১৯৩০ সনে। গৃহপালিত মুরগির মধ্যে শ্বাস প্রশ্বাস জনিত রোগের কারন হিসাবে প্রথম এই ভাইরাস আবিষ্কার হয়।তারপর ১৯৪০ সনে আর‌ও দুই প্রকার প্রানী ভাইরাস আবিষ্কার হয়। কিন্তু মানুষকে আক্রান্ত করা কোরোনা ভাইরাস প্রথম আবিষ্কার হয় ১৯৬০ সনে। সাধারন সর্দির কারন হিসাবে দুইটি কোরোনা ভাইরাস আবিষ্কার হয়। এই গুলি হ‌ইল হিউম্যান কোরোনা ভাইরাস 239E এবং হিউম্যান কোরোনা ভাইরাস OC43 । মানুষকে আক্রান্ত করা আবিষ্কার হ‌ওয়া অন্যান্য কোরোনা ভাইরাসগুলো হ‌ইল SARS CoV (2003), HCoV NL63(2004), HKU1(2005), MERS CoV(2012), SARS CoV-2 (2019) ইত্যাদি। এইগুলি  ভাইরাস বিভিন্ন শ্বাস প্রশ্বাস জনিত রোগের সৃষ্টি করে।

কোরোনা ভাইরাসের প্রকার:-
এখন পর্যন্ত অনেক ধরনের কোরোনা ভাইরাস হয়েছে। এই গুলিকে আলফা, বিটা, গামা এবং ডেল্টা এই চারটি বিভাগে ভাগ করা হয়েছে।সব ধরনের কোরোনা ভাইরাস মানুষকে আক্রান্ত করে না। মানুষকে আক্রান্ত করা প্রথম কোরোনা ভাইরাস আবিষ্কার হয় 1960 সনে। এখন পর্যন্ত সর্বমোট সাত ধরনের কোরোনা ভাইরাস আবিষ্কার হয়েছে যারা মানুষকে আক্রান্ত করতে পারে। এইগুলি হ‌ইল:-
i) 229E
ii) NL63
iii) OC43
iv) HKU1
v) MERS CoV
vi) SARS CoV
vii) SARS CoV-2

কোবিড 19 :-
কোবিড-19 অর্থাৎ কোরোনা ভাইরাস ডিসিজ -19 (COVID-19) হ‌ইল বর্তমান পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়া সবচেয়ে বড় এক ভাইরাস জনিত মহামারী রোগ।বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা 2019 সনের 30 জানুয়ারি এই রোগকে পাবলিক হেলথ ইমার্জেন্সী অফ ইন্টারনেশনেল কনসার্ন হিসাবে ঘোষনা করে। পরে 11 মার্চ মহামারী রোগ হিসাবে ঘোষনা করে।অনুমান করা যায় 2019 এর শেষের দিকে চীনে উহান প্রদেশে প্রথম এই রোগের প্রাদুর্ভাব লক্ষ্য করা যায়।তাই এই রোগকে কোবিড-19 বলা হয়। বিশ্বের প্রায় বেশীরভাগ দেশেই এই রোগে আক্রান্ত হয়ে লক্ষাধিক লোক মারা গিয়াছে। COVID-19 রোগ SARS CoV-2 অর্থাৎ Severe Acute Respiratory Syndrome Coronavirus-19 নামক এক ভাইরাসের দ্বারা সৃষ্টি হয়।
কোবিড-19 এর উৎপত্তি:-
কোবিড-19  রোগের ভাইরাস কিভাবে এবং কোথায় থেকে প্রথম  সংক্রমণ হয়েছে তার কোন সঠিক ব্যাখ্যা এখন পর্যন্ত দেওয়া সম্ভব হয় নাই।কোথায় থেকে কোবিড-১৯ মহামারী এর প্রথম রোগী  যাহাকে Patient Zero বলা হয়, সংক্রমিত হন তা এখন‌ও অস্পষ্ট।এই রোগ দ্বারা আক্রান্ত প্রথম রোগী 2019 সনের প্রথম ডিসেম্বর চীনের হোবাই প্রদেশের উহান শহরে পাওয়া যায়।এক মাসের মধ্যে রোগীর সংখ্যা দ্রুত বাড়তে থাকে। দেখা গেছে যে বেশীর ভাগ রোগী উহানে থাকা হুনান সিফুড মার্কেটের সহিত জড়িত, যেখানে সাধারণত জীবিত প্রানী বিক্রি করা হয়। সন্দেহ করা হচ্ছে এইসব প্রানী থেকে কোবিড-১৯ এর ভাইরাস মানব দেহে প্রবেশ করেছে। বিজ্ঞানীরা এখন‌ও সন্দেহে আছেন যে কোন প্রানী থেকে এই রোগের ভাইরাসটি এলো। বৈজ্ঞানিকদের এই বিষয়ে গবেষণা চলতে থাকে। এক প্রকার বাদুর যাদের বলা হয় হর্স সু বাদুর তাদেরকে RaTG-13 নামক একধরনের ভাইরাসের রিজার্ভার হিসাবে জানা যায়। এই ভাইরাসের সহিত কোবিড-19 এর ভাইরাসের সহিত প্রায় 77% সাদৃশ্য পাওয়া যায়।প্রথমে ধরা হতো বাদুর থেকে এই ভাইরাস মানব দেহে পাম সিবেট ( এক ধরনের গন্ধগোকুল বিশেষ) নামক প্রানীর দ্বারা সংক্রমিত হয়।  কিন্তু মালেশিয়ান পেঙ্গুলিন নামক এক প্রানীর মধ্যে থাকা ভাইরাসটি কোবিড-19 এর ভাইরাসের সহিত 90% থেকে 99% সাদৃশ্য পাওয়া গেছে।ইহা হ‌ইতে বুঝা যায় যে পেঙ্গুলিনে থাকা ভাইরাস মানব দেহের কোষে সহজে প্রবেশ করতে পারে।দেখা গেছে যে কোবিড-19 এর ভাইরাস SARS CoV-2 এর জিনোমের গঠন বাদুর এবং পেঙ্গুলিনের ভাইরাসের গঠনের মিশ্রিত রূপের মতো। তাহলে দুটা প্রশ্ন এখন‌ও অস্পষ্ট রয়ে গেলো যে এই দুই ধরনের ভাইরাস কোন প্রানীর মধ্যে মিশ্রিত হয়েছে এবং কোন অবস্থায় এই দুই ভাইরাস মিশ্রিত হয়?

SARS CoV-2 এর গঠন:-
কোবিড-19 হলো SARS CoV-2 নামক ভাইরাস দ্বারা সংক্রমিত এক রোগ। যেহেতু এই ভাইরাসটি কোরোনা পরিবারের অন্তর্ভুক্ত তাই ইহার গঠন দেখতে মুকুটের মতো।ভাইরাসটির আকার 50-200 ন্যানো মিটার।ইহাতে চার ধরনের গঠনীয় প্রোটিন পাওয়া যায়। যথা:- S (spike) প্রোটিন, E(envelope) প্রোটিন, M(membrane) প্রোটিন এবং N(nucleocapsid) প্রোটিন।  N প্রোটিন ভাইরাসের জিনোম ধরে রাখে এবং বাকি তিন প্রোটিন S, E এবং M মিলে ভাইরাসের আচ্ছাদনের সৃষ্টি করে।

SARS CoV-2 এর সংক্রমণ:-
কোবিড-19 এর জন্য দায়ী SARS CoV-2 নামক ভাইরাসের শুং  বা স্পাইকের  মতো কিছু অংগানু থাকে। ইহাকে পেপলোমার বলে । এই পেপলোমারে থাকে বিশেষ ধরনের গ্লাইকোপ্রোটিন ।এই প্রোটিন মানুষের ফুসফুসের মধ্যে Type II alveolar cells নামক কোষে থাকা বিশেষ ধরনের এনজাইম বা উৎসেচক Angiotensin-converting Enzyme-2 বা ACE2 এর সাথে সংযুক্ত হয়ে মানুষের কোষে প্রবেশ করে। ACE2 এর ঘনত্ব যতো বেশী হবে ভাইরাসের সংক্রমণের তীব্রতা ততো বেশী হবে। সুতরাং বুঝা গেলো এই এনজাইমের জন্য‌ই কোববিড-19 এর সংক্রমণ ফুসফুসে বেশী হয়।এই এনজাইম আর‌ও কিছু অংগেও পাওয়া যায়। কোষে প্রবেশ করার পর জিনোমের সাহায্যে ভাইরাসের বংশ বৃদ্ধি হতে থাকে।এক সময় ভাইরাসের সংখ্যা অত্যাধিক হ‌ওয়ার ফলে কোষটির বিষ্ফোরন ঘটে।এই প্রক্রিয়া ক্রমশঃ চলতে থাকলে রোগীর মৃত্যু ঘটে। তাই কোবিড-19 এ যারা মারা  যায় দেখা গেছে তাদের ফুসফুসের বিস্তৃত অঞ্চল ঝাঁঝরা হয়ে গেছে।অনেক সময় এই ভাইরাস মানুষের মস্তিষ্কেও আক্রমন করে ফলে মাথার বেদনার উপসর্গ‌ও দেখা দেয়।

কোবিড-19 এর লক্ষন সমূহ:-
এই রোগে ভাইরাসের দ্বারা আক্রান্ত হ‌ওয়ার পরে রোগের লক্ষন প্রকাশ পাওয়া পর্যন্ত সময়কে ইনকিউবেশন পিরিয়ড বলা হয়। বিভিন্ন গবেষণায় এই ইনকিউবিশন পিরিয়ড ভিন্ন ভিন্ন ধরা হয়েছে। সাধারনত 2 দিন থেকে 14 দিন পর্যন্ত সময়কে ইনকিউবেশন পিরিয়ড ধরা হয়। COVID-19 এর সর্বাধিক সাধারণ লক্ষণগুলি হ'ল জ্বর, ক্লান্তি এবং শুকনো কাশি।  কিছু রোগীর ব্যথা, সর্দি , গলা ব্যথা বা ডায়রিয়া হতে পারে।  এই লক্ষণগুলি সাধারণত হালকা হয় এবং ধীরে ধীরে শুরু হয়।  কিছু লোক সংক্রামিত হয় তবে কোনও লক্ষণ বিকাশ করে না এবং অসুস্থ বোধ করে না।  বেশিরভাগ লোক (প্রায় 80%) বিশেষ চিকিৎসার প্রয়োজন ছাড়াই রোগ থেকে সেরে ওঠে।  COVID-19 প্রাপ্ত প্রতি 6 জনের মধ্যে 1 জন গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ে এবং শ্বাস নিতে অসুবিধা বোধ করে।  বয়স্ক ব্যক্তিরা এবং উচ্চ রক্তচাপ, হার্টের সমস্যা বা ডায়াবেটিসের মতো অন্তর্নিহিত চিকিৎসা  সমস্যায় থাকা রোগীরা গুরুতর অসুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে।  জ্বর, কাশি এবং শ্বাস নিতে সমস্যাযুক্ত ব্যক্তিদের চিকিৎসার পরামর্শ নেওয়া উচিত। পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায় যে যাদের উপরোক্ত পূর্ববর্তী সমস্যাগুলো ছিলো না ,সেই সব রোগীর মৃত্যুর হার মাত্র 0.9%। আবার যাদের বয়স 65 বৎসর এর উপর তাদের মৃত্যুর হার‌ও খুব বেশী।

কোবিড-19 এর প্রতিকার:-
কোবিড-19 মহামারীর সংক্রমনে সম্ভাবনা থেকে রক্ষা পেতে হলে নিম্নলিখিত কথা গুলো পালন করা দরকার:-
1) গৃহের মধ্যে থাকা।
2) ভীড় বহুল স্থানে না যাওয়া।
3) সাবান দ্বারা হাত ধৌত করা।
4) অধৌত হাত দ্বারা চোখ, মুখ, নাক স্পর্শ না করা।
5) শ্বাস প্রশ্বাস সম্পর্কিত স্বাস্থ্য বিধি মানিয়া চলা।
6) মাস্ক পরিধান করা।
7) মুখ ঢেকে হাঁচি ও কাসি দেওয়া।
8) সোসিয়াল ডিসটেন্স অর্থাৎ কমপক্ষে অন্য লোক থেকে 6  ফুট বা 1.80 মিটার দূরে থাকা।

লক ডাউন:-
কোবিড-19 রোগটি ভাইরাস জনিত এক সংক্রামক রোগ। তাই এই রোগ থেকে রেহাই পেতে হলে একজন অন্যজন থেকে দূরে থাকতে হবে। এখন পর্যন্ত বিশ্বের প্রায় সব দেশেই এই রোগ ছড়িয়ে পড়েছে। বিভিন্ন দেশের সরকার এই রোগ যাতে বহুল ভাবে ছড়িয়ে না পড়ে তাই জনসাধারণের চলাচলের উপর কিছু নিয়মের প্রয়োগ করেছে।ইহাকে লক ডাউন বলা হয়। বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন কারনে আগেও কয়েকবার লক ডাউন আইন প্রয়োগ করার নজির আছে। যেমন 2001 সনের সেপ্টেম্বরের 11 তারিখ আমেরিকায় সন্ত্রাসী আক্রমনের পর, 2019 সনের আগস্ট মাসে জন্মু ও কাশ্মীরে 370 আইন প্রয়োগের পর ইত্যাদি। কোবিড-19 এর প্রাদুর্ভাবে লক ডাউন আইন রোগটির বিস্তার লাভে যথেষ্ট বাঁধা প্রদান করেছে। সুতরাং আমাদের‌ সকলের‌ই সরকার প্রদত্ত এই আইন মেনে চলা অত্যন্ত দরকার।
         সবশেষে একটি কথা বলতে চাই, এই রোগ থেকে বাঁচতে হলে খুব‌ই বেশী পরিমানে সতর্কতা অবলম্বন করা দরকার। রোগের উপসর্গগুলি দেখা দিলে দেরী না করে ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করা প্রয়োজন।  কেননা এই মহামারী রোগের ভাইরাসটি অত্যন্ত ছোট। কারন ছোট বস্তুগুলি ভয়ানক হলে মারাত্মক রূপ ধারন করতে পারে।
ধন্যবাদ-
জহিরুল ইসলাম(রাতাবাড়ী)

No comments:

Post a Comment